বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সুব্রত বাইন আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্ণার নোটিশ প্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। যার বিরুদ্ধে প্রায় ৩০টির অধিক খুনের মামলা রয়েছে। প্রায় সব মামলাতেই সাজাপ্রাপ্ত তিনি। গত ২৭ মে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনারবাংলা সড়কের একটি তিনতলা বাড়ি থেকে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী তারই সহযোগি মোল্লা মাসুদসহ গ্রেফতার হন তিনি। সুব্রত বাইনদের মত শীর্ষ সন্ত্রাসী আটকের সংবাদ দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে মোটা দাগে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তবে সুব্রত বাইনের মত শীর্ষ সন্ত্রাসী আটকে জনমনে যতটা না আলোচনার জন্ম দেয় তার চেয়ে বেশি আলোচিত হয় কুষ্টিয়া থেকে আটকের বিষয়। প্রশ্ন সুব্রত বাইনদের মত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কীভাবে কুষ্টিয়াকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেঁছে নেয়। কাদের ছত্রছায়ায় তাদের আগমন, তাদের মিশনই বা কী? সহযোগিসহ সুব্রত বাইনকে আটকের পর তার মিশন সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে অনেক কিছু উঠে আসলেও কুষ্টিয়ায় কীভাবে আসেন, কেনই বা আসেন পরিস্কার তথ্য পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। তবে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে সুব্রত বাইন ও তার সহযোগী যে বাড়ি থেকে আটক হয়েছেন সেই বাড়িটি ভাড়া করে দেন হেলাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। তিনি সুব্রত বাইন যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তার দক্ষিণ পাশের তিনতলা বাড়ির বাসিন্দা। যে বাড়ি থেকে সেনাবাহিনী নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী উদ্ধার করে সিসি টিভি’র ডিভাইসসহ গুরুত্বপুর্ণ ডকুমেন্ট। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীকে কুষ্টিয়ায় আশ্রয়দাতা হেলাল উদ্দিন এক রহস্যময় ব্যক্তি। পেশায় পার্টস ব্যবসায়ী হলেও তার রয়েছে আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বাড়ী ভাড়া, বাসা থেকে খাবার রান্না করে খাওনো ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা হেলালকে নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনীর এতবড় অভিযানের পরও হেলাল গ্রেফতার না হওয়ায় সুব্রত বাইনদের কুষ্টিয়া অবস্থান সম্পর্কে রয়েছে ধোয়াশা। যে এলাকা হতে গ্রেফতার হয়েছে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ সেই কালিশংঙ্করপুর এলাকার মানুষও রয়েছে চরম ভীতির মধ্যে। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে কুষ্টিয়া হতে গ্রেফতার হওয়ায় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জিজ্ঞাসাবাদে তাদের মিশন সম্পর্কে জানিয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা করার পরিকল্পনা করছিল। কুষ্টিয়ায় আস্তানা গড়ে তোলার বিষয়টি পরিস্কার হতে অভিযান চলছে আশ্রয়দাতা হেলালকে গ্রেফতারের। বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। হেলালের বিষয়েও খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে।
কে এই হেলাল উদ্দিন?
২৭ মে ভোর থেকে পরিচালিত সেনাবাহিনী নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ আটকের পর থেকেই ঘুরে ফিরে আসে হেলালের নাম। কারন ওই হেলালের মাধ্যমেই সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনারবাংলা সড়কের তিনতলা ওই বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে ওঠেন। বাড়িটি চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা পৌরসভার প্রয়াত মেয়র মীর মহিউদ্দিনের। হেলালের পরিবারের সাথে প্রথম পরিচয় হয় মোল্লা মাসুদের। তার পর আসেন সুব্রত বাইন। অভিযানের পর এমন তথ্যই স্থানীয় গণমাধ্যমসহ জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হলেও বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মুলত: হেলাল উদ্দিনের বাবা প্রয়াত আব্দুল কুদ্দুসের সাথেই প্রথমে পরিচয় ঘটে সুব্রত বাইন। বাংলাদেশের কোন এক ভারতীয় সীমান্তে বসবাস করতেন আব্দুল কুদ্দুস। এই আব্দুল কুদ্দুস গত ৩ মাস আগে মৃত্যুবরণ করছেন। ভারত সীমান্তে বসবাসের সুবাদে তার সাথে পরিচয় হয় সুব্রত বাইনের সাথে। সেই সূত্র ধরে সুব্রত বাইনদের সাথে যোগাযোগ। হেলালদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলনা। মুলত: জমি কেনাবেচা থেকেই কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে তাদের। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সাথে পরিচয়ের পর থেকে কপাল খুলে যায় হেলালদের পরিবারের। সুব্রত বাইনের সহায়তায় পাড়ি জমান দুবাইয়ে। সেখানে সুব্রত বাইনও থেকেছেন বেশ কয়েক বছর। বছর দশেক দুবাইয়ে অবস্থান শেষে বছর দেড়েক আগে দেশে ফিরে আসেন হেলাল। অপরাধ জগতে যখন সুব্রত বাইনদের জয়জয়কার তখন মাঝে মধ্যেই হেলালদের বাড়িতে আসতেন সুব্রত বাইনেরা। মাস দেড়েক আগে বাসিন্দা হয়ে যান কালিশংকরপুরের আলোচিত ওই তিনতলা বাড়ির। যে বাড়ি থেকে ২৭ মে তারই সহযোগী মোল্লা মাসুদসহ আটক হন। উদ্ধার হয় অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা বারুদ।
স্থানীয় বাসিন্দা মানিক হোসেন জানান বেশ কিছুদিন ধরেই হেলালের বাড়িতে একটি খয়েরি রঙের বিলাসবহুল গাড়ী আসত। ওই গাড়িতে যারা আসত তাদের মধ্যে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে দেখেছি। আরো যারা আসতেন তাদের দেখলে চিনতে পারব। পরে মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন মীর মহিউদ্দিনের তিনতলা বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতেন। তারা আটক হলে জানতে পারি ওরাই দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা শাহীন জানান মানুষ হিসেবে ওরা সামাজিক ছিলনা। প্রতিবেশীদের সাথে ভালো আচরণ করতনা। হেলালের ছোট ভাই বেলাল যিনি দুবাই থাকেন। তিনিসহ অন্য ভাইগুলোর ব্যবহার একই রকম। তাই ঘৃণায় তাদের সাথে কেউ যোগাযোগ রাখতনা।
সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের এই সদস?্য কয়েক বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে বসবাস করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ফেরত যান। এই হেলাল, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের বেশ ঘনিষ্ঠ। কুষ্টিয়ার যে বাড়ি থেকে সুব্রত ও মোল্লা মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়, সেই বাড়িটি তিনিই ভাড়া করেছিলেন। বিশ্বস্ত মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাশকতা ও গুপ্ত হত্যার মিশনে অস্ত্র ও লজিস্টিক সাপোর্টের কাজটি তার করার কথা ছিলো।
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা শাহজাহান তপন জানান হেলালরা চার ভাই। সবার বড় রাশিদুল ইসলাম। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামীয়া কলেজে পিওন পদে চাকুরী করেন। মেজোভাই হাফিজ মটরপার্টসের ব্যবসা করেন। যা তৈরী করেন বাড়িতেই। সেজো হেলাল উদ্দিন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তিনিই। সম্প্রতি দুবাই থেকে এসেছেন। সবার ছোট ভাই বেলাল বর্তমানে দুবাইয়ে চাকুরীর করছেন। যে বাড়িতে তারা বসবাস করেন ওই বাড়িটি তাদের নিজের। ১৫-১৬ বছর আগে এই বাড়িটি তারা কিনেন। তার আগে কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান হাউজিং এলাকার রুবেল নামে এক ব্যক্তির সাথে হেলালের ঘনিষ্ঠ সখ্যতা ছিল। আন্ডারওয়ার্লের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাথেও হেলালের ওঠাবসা রয়েছে। হেলালের চালচলন ওঠাবসা অন্যদের থেকে আলাদা। সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসেবে নিজেকে জাহির করতেন।
রাজনৈতিক পরিচয়:
রাজনৈতিকভাবে হেলালদের সখ্যতা গড়ে ওঠে আওয়ামী লীগের সাথে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের সাথে তাদের পরিবারের বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হেলালের বড় ভাই রাশিদুল ইসলাম কুষ্টিয়া ইসলামীয়া কলেজে পিওন পদে যে চাকরিটা পেয়েছেন তা দিয়েছেন হানিফই। সেই সুবাদে রাশিদুলের পরিবারের সদস্যরা হানিফের প্রতি একটু বেশিই অনুগত। পিটিআই রোডের হানিফের বাড়ির সামনের টিনশেডে প্রায়ই বসতে তিনি। যেকারনে হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়। বিগত সংসদ নির্বাচনেও কোমর বেঁধে হানিফের পক্ষে কাজ করেছেন তারা।
রহস্যময়ী সুন্দরী নারী কে?
হেলালের আশ্রয়ে থাকা সুব্রত বাইন এবং মোল্লা মাসুদের সাথে এক সুন্দরী নারীকেও দেখা গেছে ওই বাড়িতে। যে বাড়িতে থাকতেন সুব্রত বাইনেরা। সুব্রত বাইন আর মোল্লা মাসুদকে খুব একটা দেখা না গেলেও স্থানীয়রা ওই বাড়ির সামনে মাঝে মধ্যেই পোশাক-আষাক মেলে দিতে দেখতে পান তাকে। তবে তিনি আসলে কে কি তার পরিচয় তা জানতে পারেনি কেউই। দ্বিতীয় তলায় থাকা কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী শাহীন আলম জানান ওপর থেকে প্রায় দেখতে পেতাম একজন নারী প্রায়ই জামা কাপড় মেলে দেন। তিনি যে নিচতলাতেই থাকতেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনি। মঙ্গলবার সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তারের পর প্রশ্ন ওঠে তাদেরই সাথে ওই ফ্লাটে থাকা সুন্দরী নারীটি আসলে কে? নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেউ কেউ বলেন ওই নারী সুব্রত বাইনের স্ত্রী হবে হয়ত। আবার কেউ বলেন তিনি আসলে তাদের রক্ষিতা। হেলালের মাধ্যমেই আগত ঘটে তার।
সুব্রত বাইনের আমলনামা
সুব্রতর নামে ৩০টিরও অধিক খুনের মামলা রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোতেই এই সন্ত্রাসী সাজাপ্রাপ্ত, এছাড়াও অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজি সহ প্রায় ১০০ মামলার আসামীও তিনি। ২০০১ সালে পুরস্কার ঘোষিত এই শীর্ষ সন্ত্রাসী আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্ণার নোটিশ প্রাপ্ত।
প্রায় দেড় বছর আগে বিশেষ ব্যবস্থায় ভারত থেকে তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য ছিলো টার্গেটেড রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার উদ্দেশ্যে ভিন্ন পরিচয়ে যুক্তরাজ্যে পাঠানোর, তৈরিও করা হচ্ছিলো সেভাবে। কিন্তু ৫ই আগষ্ট ২০২৪ পরবর্তী সময়ে তার আশ্রয়দাতারা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাওয়ার কারণে পেশাদার এই অপরাধী সাধারণ জনগণের সাথে মিশে যায়। ২০০১ থেকে ভারতে সেদেশের গোয়েন্দা সংস্থা আইবি’র ( ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) ছত্রছায়ায় ছিলেন সুব্রত। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী তাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে অবস্থান করা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন উলফা, নাগাল্যান্ড লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা সহ, মোস্তাকিম চাপ কাবাব এর মালিক মোস্তাকিমকে হত্যা করিয়েছে। বিশেষ সূত্রমতে, বর্তমানে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কাজ করছে তিমোথি সুব্রত বাইন হিসেবে পরিচিত এই সন্ত্রাসী। আগষ্ট পরবর্তী সময়ে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মতিঝিলের ইখতিয়ার (মালিবাগ সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশ হত্যা মামলার আসামী) এর মাধ্যমে সুব্রত অস্ত্র কিনেন। থানা থেকে লুট হওয়া প্রায় ১৭টি অস্ত্র বর্তমানে তার হেফাজতে রয়েছে। সুব্রত তার ডান হাত আরেক পুরস্কার ঘোষিত সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ মতিঝিল গোপীবাগের একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক। সুব্রত বাইন সুইডেন আসলামের সাথে দেখা করে কাওরান বাজার একসাথে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারেও সমঝোতা করেছে। এছাড়াও তাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে হাসিনার অনুগত কিছু নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা পরোক্ষ মদদ দেন বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।