সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেফতার

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ গতকাল মঙ্গলবার (২৭ মে ২০২৫) ভোরে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকায় সোনার বাংলা মসজিদের পাশে একটি বাড়িতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তার সহযোগী মোল্লা মাসুদকে গ্রেফতার করেছে। স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অভিযান চলাকালীন ওই বাড়ি থেকে ২টি পিস্তল, ৪টি ম্যাগাজিন ও ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযানের সময় বাড়িটি ঘিরে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি চালানো হয় এবং দুজনকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ বাংলাদেশের অপরাধ জগতের অন্যতম কুখ্যাত ও শীর্ষ সন্ত্রাসী, যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল এবং অবশেষে কুষ্টিয়াতে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে।

সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদের পাশে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র প্রয়াত মীর মহিউদ্দিনের মালিকানাধীন একটি তিনতলা বাড়ির নিচতলা ভাড়া বাসা থেকে সেনাবাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করে। অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তিন ঘণ্টা ধরে ওই বাড়িটি ঘিরে রাখেন এবং অভিযান শেষে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

প্রায় দেড় মাস আগে মীর মহিউদ্দিনের বাড়ীর পেছনের বাড়ির স্থানীয় হেলাল উদ্দিন নামের এক বাসিন্দা ওই বাড়ির নিচতলা ভাড়া নেন এবং ১২-১৫ দিন আগে অতিথি পরিচয়ে একজনকে সেখানে রেখে যায়। বাড়িটি ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া দেওয়া আছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও ছাত্রদের ভাষ্যমতে, বাড়ির নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন, তা তারা জানতেন না, তবে একজনকে দিনে দু-একবার শুধু খাবার খেতে বের হতে দেখতেন।

কে এই সুব্রত বাইন:

সুব্রত বাইন বাংলাদেশের একজন কুখ্যাত অপরাধচক্র নেতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী। নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অপরাধজগতের অন্যতম এক আলোচিত নাম। ঢাকার মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে তার অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। প্রথম জীবনে সে ওই এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিল। সেখান থেকেই অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এবং “বিশালের সুব্রত” নামেও পরিচিতি পায়। সে সেভেন স্টার গ্রুপের প্রধান ছিল, যা ঢাকার অপরাধজগতে অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি চক্র। তার বিরুদ্ধে অন্তত ৩০টি খুনের মামলা রয়েছে এবং সে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামি। দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, জমি দখল, খুন-জখমসহ নানা অপরাধে তার নাম জড়িত। ২০০১ সালে সরকার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় তার নাম ছিল। তার নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে এবং তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০০৪ সালে পুলিশের তাড়া খেয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যায়, পরে নেপালেও আত্মগোপন করে। কলকাতা ও নেপালে একাধিকবার গ্রেফতার হয় এবং পরে আবার আত্মগোপনে চলে যায়।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে গোপনে দেশে ফিরে আসে এবং কিছুদিন আগে (প্রায় এপ্রিল ২০২৫) কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকায় গোপন আস্তানায় ওঠে।

বর্তমানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্যের পেছনে সুব্রত বাইন এবং তার সহযোগীদের হাত রয়েছে। তার পক্ষে আর্থিক লেনদেন ও অপারেশনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কিছু সহযোগী, যেমন বাপ্পি আহমেদ ও ইখতিয়ার উদ্দিন। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় তারা সক্রিয়ভাবে অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা করছিল এবং নতুন কোনো বড় ধরনের অপরাধ পরিকল্পনা করছিল।

কে এই মোল্লা মাসুদ:

মোল্লা মাসুদ বাংলাদেশের অপরাধজগতে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও আন্ডারওয়ার্ল্ডে “কিলিং মেশিন” নামে পরিচিত। সে সেভেন স্টার গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল। তার বাড়ি ঝালকাঠির মহাদেবপুরে। বাবার নাম আমজাদ হোসেন। ঢাকার রমনার মিরবাগে তাদের বাসা। এসএসসি পাসের পর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হয়। ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলÑছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেয়। শিবিরে থাকার সময় জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের দেহরক্ষী হিসেবেও কাজ করেছে। নিজ হাতে অন্তত দুই ডজন খুন করেছে। চাঁদাবাজি, হুমকি, খুনÑএসব কাজে তার নাম ছিল ভয়ংকরভাবে আলোচিত। আন্ডারওয়ার্ল্ডে খুনিকে “স্ট্রাইকার” বলা হয়, আর  সে ছিল সেভেন স্টার গ্রুপের একমাত্র স্ট্রাইকার। ২০০১ সালের ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় তার নাম ছিল ১৩ নম্বরে। তার নামেও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি আছে। পুলিশের তাড়া খেয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হয় এবং পরে জামিনে মুক্তি পায়।

মোল্লা মাসুদ ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত ছিল এবং সেই সময় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাবেক আমির গোলাম আযমের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করেছে।

বিশেষভাবে, সে মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করার পর মগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হয় এবং ছাত্রশিবিরে সক্রিয় হয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিএস পদে নির্বাচন করার সময় থেকেই গোলাম আযমের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। সেই সুসম্পর্ক থেকেই তিনি গোলাম আযমের বডিগার্ড বা দেহরক্ষী হয়। সংক্ষেপে, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকাকালীন সময়ে মোল্লা মাসুদ জামায়াত নেতা গোলাম আযমের দেহরক্ষী ছিল এবং পরে সেখান থেকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে।

কে এই হেলাল:

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মীর মহিউদ্দিনের পেছনের বাড়ি “হেলাল” নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দার, যিনি কিছুদিন আগে ছাত্রাবাস ওই বাড়িটি ভাড়া নেন এবং অতিথি পরিচয়ে একজনকে (পরবর্তীতে সুব্রত বাইন) বাড়ির নিচতলায় রেখে যান। বাড়িটি পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি, আলমডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র প্রয়াত মীর মহিউদ্দিনের। বাড়িটি ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া নেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার শাহীন আলম। হেলাল উদ্দিন কালিশংকরপুর এলাকার মৃত আব্দুল কুদ্দুসের চার ছেলের মধ্যে তৃতীয়। হেলাল উদ্দিন কাটাইখানা মোড়ে মোটরসাইকেল পার্টস এর ব্যবসা করেন।

রোজার ঈদের পরে ছাত্রাবাসের পিছনের বাড়ির মালিক হেলাল উদ্দিন ছাত্রাবাস ম্যানেজার শাহিন আলমকে বলেন তাদের বাড়ির সংস্কার কাজ করাবে কিন্তু তার এক আত্মীয় ব্যবসায়িক কাজে কয়েক মাস কুষ্টিয়াতে থাকবেন এবং ব্যবসায়িক মালামাল রাখবেন এজন্য তাদের বাড়ির নিচতলাটি ভাড়া নেবার প্রস্তাব দেয়। শাহিন আলম প্রতিবেশী হেলালকে জানান যেহেতু এটি ছাত্রাবাস বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে জানাবো। পরবর্তীতে শাহিন আলম বাড়ির মালিক মরহুম মীর মহিউদ্দিনের বড় মেয়ে মৌনালীর সাথে কথা বলে হেলালকে ভাড়া দেয়। হেলাল ছাত্রাবাসের নিচতলা ভাড়া নিয়ে বাড়ীর দোতলায় একটি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেন এবং তার মনিটর রাখে নিজের বাড়ীতে। গত দেড় মাস যাবত ছাত্রাবাসের নিচতলায় অবস্থানকারীদের খাবার আসতো হেলালের বাড়ী থেকে। হেলালের স্ত্রী নিজে রান্না করতেন এসব খাবার।

সেভেন স্টার সন্ত্রাসী গ্রুপের পুনরায় সক্রিয় হওয়া দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি ছিল, কারণ তারা পুরোনো চক্র ও সহযোগীদের নিয়ে চাঁদাবাজি, জমি দখল, সন্ত্রাসী হামলা ও খুনসহ নানা অপরাধে যুক্ত ছিল।

তাদের গ্রেফতারের মধ্যদিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের অপরাধ দমনে একটি বড় সাফল্য অর্জন করেছে। তবে, এই চক্রের আশ্রয়দাতা ও স্থানীয় সহযোগীদের পরিচয় এবং ভূমিকা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়Ñএ বিষয়ে আরও তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপ জরুরি।

সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের গ্রেফতার দেশের নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, তবে তাদের নেটওয়ার্ক ও সহযোগীদের চিহ্নিত করে দমন করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।