শৈলকূপা প্রতিনিধি ॥ ঝিনাইদহের শৈলকুপার ভূমিকন্যা, বাংলার মহীয়সী নারী, সংগ্রামী কৃষক নেতা, তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী, নাচোলের রাণীমা ইলামিত্রের ৯৯তম জন্মদিন আজ ১৮ অক্টোবর। ১৯২৫ সালের এদিনে তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধিন বাংলার একাউটেন্ট জেনারেল। চাকরিসূত্রে তিনি সেসময় কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। ইলামিত্রের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায় হলেও তার পৈত্রিকবাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের বাগুটিয়া গ্রামে। শৈশব ও কৈশোরের অনেক সময় কেটেছে তার ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামের রায়পাড়ার বাড়িতে। শৈলকুপা উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণে ১৩ কিলোমিটার দূরে বাগুটিয়া গ্রামে কাঁচা রাস্তার ধারে ইলামিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন এর পৈত্রিক দোতলা বাড়িটি এখনও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। চুন-সুড়কি দিয়ে গাঁথা ৯ কক্ষবিশিষ্ট দালানটি ইতিহাসের সাক্ষী হলেও তা রয়েছে অন্যের দখলে। শুধু বাড়ি নয় ইলামিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের রেখে যাওয়া প্রায় শত বিঘা জমিও ভোগদখল করছেন দখলদাররা। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বাড়িটির বেহাল অবস্থা। ভেঙে ফেলা হচ্ছে সুরম্য ইটের গাঁথুনি ও ভিতগুলো। অযতœ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে সংগ্রামী এ কৃষকনেতার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। কারুকার্যখচিত বাড়িটির জানালা দরজাসহ, দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ছে। তার স্মৃতি সংরক্ষণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি তেমন কোনো উদ্যোগ। এমনকি তার জন্ম-মৃত্যু দিবসে নেয়া হয়না কোনো কর্মসূচি। যা থেকে নতুন প্রজন্ম ইলামিত্র ও তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারে। জন্মের সময় ইলামিত্রের নাম ছিল ইলা সেন। ১৯৪৫ সালে চাপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার বাড়ির ছোটছেলে দেশকর্মী কমিউনিস্ট নেতা রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সাথে তার বিয়ে হয়, রমেন্দ্রনাথ মিত্র মালদহের রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদার মহিমচন্দ্র ও বিশ^মায়া মিত্রের ছোটছেলে। বিয়ের পর তার নাম হয় ইলামিত্র। বিয়ের পর ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চাপাইনবাবগঞ্জে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। জমিদার পুত্রবধু হয়েও বাংলার শোষিত বঞ্চিত কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সংগ্রাম করতে গিয়ে হয়ে ওঠেন কৃষকনেতা ও সাঁওতালদের রাণীমা। এসময় তিনি কয়েকবার জেল খাটেন। ভোগ করেন অমানুষিক নির্যাতন। তিনি আজীবন কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে গেছেন। ইলামিত্রের স্মৃতিবিজড়িত ঝিনাইদহের শৈলকুপার পৈত্রিক ভিটা ও স্মৃতি সংরক্ষণে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ‘ইলামিত্র স্মৃতিরক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন গঠিত হয়েছে। সংগঠনের উদ্যোগে জন্ম-মৃত্যুদিবসে মানববন্ধন, র্যালী, আলোচনাসভা করা হয়ে থাকে। জেলা পর্যায়েও ইলামিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি সংগঠন আছে। বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য তারা কয়েকবছর আগে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করে। বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় লেখালেখির ফলে ৪ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহকারি সচিব মোঃ জিয়াউদ্দিন ভূইয়া স্বাক্ষরিত ৪৩.০০.০০০০.১১৪.০২৭.১১২.১৪/০১ (১) নং স্মারকে সরকারের প্রত্মতত্ব অধিদপ্তর বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্ত দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তৎকালীন ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার কয়েকবার বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন। কিন্ত আজ অবধি বাড়িটি সংরক্ষণ এর জন্য তেমন কোনো কর্মদ্দ্যোগ দেখা যায়নি। ইলামিত্র স্মৃতি রক্ষা আন্দোলনের নেতারা মনে করেন বাড়িটি সংরক্ষণ করা হলে এটি দর্শনার্থীদের জন্য পর্যটন স্থান হতে পারে। রক্ষাপাবে বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব। বাগুটিয়া জরিপ বিশ^াস কলেজের অধ্যক্ষ সুব্রত কুমার মল্লিক বলেন-ঐতিহাসিক এ বাড়িটি সংরক্ষণ করে এখানে একটি মিউজিয়াম গড়ে তুলতে পারলে এখানে অনেক পর্যটকের আগমন ঘটবে এলাকার ছেলেমেয়েরা একজন মহীয়সী নারী ও তার সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে জানতে পারবে। বাগুটিয়া গ্রামের ১১৬নং মৌজার ২৩৪৫ দাগের উপর দি¦তল বাড়িটি যে একজন সংগ্রামী মহীয়সী নারীর বিষয়টি অনেকের কাছে আজও অজানা। তাই বাড়িটি উদ্ধার করে এখানে ইলামিত্র স্মৃতি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার দাবি আন্দোলনকারীদের। বাড়িটিতে বর্তমানে বসবাস করেন হাজি কিয়াম উদ্দীনের পরিবার। বাড়িসহ নগেন্দ্রনাথ সেন এর জায়গাজমি সরকারি খাতায় ভিপি তালিকাভুক্ত হলেও বসবাসকারীদের দাবি তারা বিনিময়সূত্রে বাড়িসহ ৮৪ বিঘা জমি ভোগদখল করেন। হাজি কিয়ামুদ্দিনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম জানান উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ পেলে তারা বাড়িটি ছেড়ে দিতে রাজি আছেন।