কুমারখালী প্রতিনিধি ॥ ‘ গরীব ঘরের সন্তান। তাই দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি দুলাভাইয়ের সঙ্গে কাজে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা ( আন্দোলনকারীরা) আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিল হাত, পা, শরীর। আওয়ামী লীগ নেতার ভবন বলেই আগুন দিয়েছিল ওরা। শামীম ওসমানের ভবনই আমাদের জীবন কাল। ‘ শনিবার (২৭ জুলাই) দুপুরে দোচালা টিনশেডে মাটির ঘরে বিছানায় শুয়ে – বসে আক্ষেপ কর কথা গুলো বলছিলেন কুষ্টিয়া জেলার মো. মাহবুব বিশ্বাস (১৬)। তিনি কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের কৃষক আক্কাছ বিশ্বাসের ছোট ছেলে। গত ২০ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশ। সে সময় তাঁর দু’চোখে ছলছল জল আর হতাশার ছাপ ছিল। এছাড়াও সেদিনের আগুনে পুড়ে মারা গেছেন মাহবুবের দুলাভাই ওহাব মন্ডলের ছেলে সেলিম মন্ডল (২৮), ফুফাতো দুলাভাই মৃত সাবের আলীর ছেলে আব্দুস সালাম (২৪)। আহত হয়েছেন প্রতিবেশী ওয়াজেদ আলীর ছেলে মো. ফয়সাল মন্ডল (১৮), মো. কাদেরের ছেলে মো. পারভেজ, আবুল মাস্টারের ছেলে আব্দুল হামিদ। হামিদ ঢাকায় একটি হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁরা সবাই ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বলেন, একফোঁটাও ঘুমাতে পারছিনা। চোখ বুজলেই ভেসে উঠছে সেদিনের দৃশ্য। আগুনের কালো ধোঁয়া। কানে বাজছে গুলির শব্দ। কাঁটছে নির্ঘুম রাত। বিশ্বাসই হয়না যে এখনও বেঁচে আছি। জানা গেছে, নারায়নগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় একটি দশতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় সাজসজ্জার কাজ করছিলেন মাহবুব, সেলিম, সালাম, ফয়সাল, হামিদ, পারভেজসহ অন্তত ১৪ জন। তাঁদের ভাষ্য, ভবনটির মালিক নারায়নগঞ্জ ৪ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান। এমপি শামীম ওসমান আটতলায় থাকতেন। ভবনের পাঁচতলায় ছিল একটি পুলিশ ক্যাম্প। আর নীচতলায় ছিল মার্কেট। আন্দোলনকারীরা শামীম ওসমানের লোক ভেবে দুপুরেই আহত মাহবুব ও ফয়সালের মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে মারধর করে। পরে শ্রমিক পরিচয় দিয়ে রক্ষা পান তাঁরা। এরপর বিকেল ৪ টার দিকে ভবনের বাইরে থেকে আন্দোলনকারী ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। শোনা যায় গুলির শব্দও। পরে সাড়ে ৪ টার ব্যাংকের প্রবেশপথে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। মাহবুবের বাবা আক্কাছ বিশ্বাস বলেন, ওরাতো আন্দোলনে ছিলোনা। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। শুধু আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি বলে আগুন লাগিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। আগুনে পুড়ে আমার দুই জামাই মারা গেছেন। ছেলে ও আত্মীয়রা আহত হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠ বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাই। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আহত ফয়সাল মন্ডল বলেন, আমরা ১৪ জন ব্যাংকে কাজ করছিলাম। দুপুরেই ভবনের বাইরে থেকে শুধু গুলির আওয়াজ আসছিল। আর বিকেলে ব্যাংকের গেটে আগুন দিয়েছিল আন্দোলনকারী। আগুনের কারনে প্রচুর ধোঁয়া ছিল। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ভবন থেকে বেরুনোর জন্য আমরা কয়েকজন মিলে একটি দেওয়াল ও জানালার গ্লাস ভেঙেছিলাম। পরে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে আমার হাত, পা ও শরীর পুড়ে যায়। এরপর পুড়া নিয়েই নিচে এসে কিছুদুর হেটে সড়কের ওপর পড়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে একজন অজ্ঞাত আপু আমাকে আর মাহবুব প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সিএনজিতে তুলে দেন। সিএনজি করে ওই রাতে ঢাকা সাভার এলাকায় এক আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিই। সেখান ২১ জুলাই অ্যাম্বুলেন্স করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌছায় আমরা। তিনি বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে জীবিকার্জনের পথ বেঁচে নিয়েছিলাম। এখন শুধু বুক ভরা হতাশা আর আতঙ্ক। কোনো ভাবেই ভুলতে পারছিনা সেদিনের ঘটনা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত কুমারখালী বাড়ি এমন একজন ছাত্রসহ ৪ জন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পরিবার থেকে লিখিত আবেদন করলে সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ আসলে তা প্রদান করা হবে।